নুরুল আলম:: খাগড়াছড়িতে সরকারি-বেসরকারি উন্নয়ন কাজের অজুহাতে বিভিন্ন নদী-খাল ও ছড়া থেকে বেপরোয়াভাবে চলছে বালু উত্তোলন। জেলায় সরকারিভাবে বালু উত্তোলনের জন্য ৯টি মহালে বৈধ ইজারাদার নিয়োগ করা হলেও খাগড়াছড়ি সদরসহ বিভিন্ন উপজেলার পাশ দিয়ে প্রবাহিত প্রায় শতাধিক স্থানে দিনে-রাতে অবৈধভাবে বালু উত্তোলন চলছে।
প্রভাবশালী মহলের আগ্রাসনের শিকার হয়ে পুরো জেলার নদী-খাল-ছড়াগুলো এখন যেনো বালুখেকোদের নিষ্ঠুরতার বলি। জানা যায়, বৈধ বালুমহাল থেকেও ড্রেজার (গভীর থেকে বালু উত্তোলনের বিশেষ বৈদ্যুতিক যন্ত্র) দিয়ে বালু তোলার আইনি কোন সুযোগ নেই।
খোদ জেলাসদরেই প্রকাশ্যে বালু উত্তোলন ও কেনা-বেচার হাট বসলেও দেখার কেউই নেই। এভাবে নির্বিচারে বালু উত্তোলনের কারণে বিভিন্ন স্থানে ভাঙন দেখা দিয়েছে। ধারণ ক্ষমতার বেশি ওজনের বালু ভর্তি ট্রাক ও ট্রাক্টর চলার কারণে গ্রামীণ সড়কগুলোতেও অকালে ভাঙন ধরছে। অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের ফলে বৈধ বালুমহাল ইজারাদাররা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
অথচ প্রভাবশালীদের ভয়ে তারাও মৌখিক বা লিখিত কোন অভিযোগ দিতে পারছেন না বলে স্বীকার করেছেন। তাদের অভিযোগ, বৈধ ইজারাদার হবার পরও এসব অবৈধ বালু উত্তোলনের দায়ভারও আমাদের উপর চাপিয়ে দিচ্ছে প্রশাসন। সরকার হারাচ্ছে বিপুল পরিমাণ রাজস্ব। নদী-খাল-ছড়াগুলোর স্বাভাবিকতা বিনষ্ট হচ্ছে।
একজন ইজারাদার নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, প্রশাসনের কিছু ব্যক্তি চলমান কিছু বড় অংকের নির্মাণ কাজের ঠিকাদারের সাথে মিলে যখন-তখন যেখান থেকে খুশী সেখান থেকেই বালু উত্তোলন করছেন। প্রকাশ্যে ড্রেজার ব্যবহার করলেও সবাই যেনো জেনেও না জানার ভান ধরছেন।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মাত্রাতিরিক্ত বালু খেকোদের তাণ্ডবে জেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত উপজেলা মানিকছড়ি। উপজেলাটির বিভিন্ন খাল-ছড়া থেকে বৈধ-অবৈধভাবে বালু উত্তোলনে খাল ও ছড়ার মানুষের বসতবাড়ি-জমি ভাঙনের শিকার হচ্ছে প্রতিনিয়িত। বালুবাহী বিভিন্ন ভারী যানবাহনের চাপে উপজেলার অধিকাংশ গ্রামীণ সড়ক নির্মাণ ও সংস্কারের অল্প দিনের মাথাতেই চলাচল অযোগ্য হয়ে পড়ে।
খাগড়াছড়ি সদরের চেঙ্গী নদী, খাগড়াছড়ি খাল ও রাঙাপানিছড়া, দীঘিনালা উপজেলার মাইনী নদী, মানিকছড়ি ও পানছড়ি পাশ দিয়ে প্রবাহিত চেঙ্গীসহ বিভিন্ন ছড়া, মানিকছড়ি খাল, চেঙ্গুছড়া ও বড়বিল, গুইমারা উপজেলার বাইল্যাছড়িসহ বিভিন্ন নদী ও খালগুলো থেকে ব্যপরোয়াভাবেই বালু উত্তোলন চলছে।
বিশেষ করে জেলার মানিকছড়ি এবং খাগড়াছড়ি সদর থেকেই সবচেয়ে বালু উত্তোলন হবার অভিযোগ করেছে ‘খাগড়াছড়ি পরিবেশ সুরক্ষা আন্দোলন। এসময় সংগঠনটির প্রতিনিধিরা জানায়, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা সত্বেও জেলায় অবাধে বালু উত্তোলন, পাহাড়কাটা, পুকুর-জলাধার ভরাটের দৃশ্যত প্রশাসনের কোন প্রতিবিধান চোখে পড়ছে না। বালু উত্তোলনকারীদের ছত্রছায়ায় পরিবেশ আইন পরিপন্থী এসব অপতৎপরতা অব্যাহত থাকলেও দেখেও যেনো কেউ-ই এমন অবস্থা বিরাজ করছে জেলাজুড়ে।
সরেজমিনে মানিকছড়িতে দেখা গেছে, কোন ধরণের নিয়মনীতি তোয়াক্কা না করেই অন্তত অর্ধশত স্থান থেকে দিনে-রাতে বালু উত্তোলন চলছে। উত্তোলিত সে বালু ট্রাকে করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। বালু ভর্তি ট্রাক চলাচলের কারণে সবচেয়ে নাজুক অবস্থা গ্রামীণ সড়কগুলোর। বালু মহাল ও মাটি ব্যবস্থাপনা বিধি না মানার কারণে নদী-খাল ও ছড়া ভেঙ্গে এবারো-থেবড়ো হয়ে গেছে। তবে বালু খেকোদের ভয়ে মুখ খুলতে রাজি নয় কেউ।
ভাড়ায় চালিত মোটরসাইকেলের এক চালক নাম প্রকাশ না শর্তে বলেন, পুরো সড়কটি বালু খেকোরা নষ্ট করে দিয়েছে। দিনে-রাতে এ সড়ক দিয়ে চলে অতিরিক্ত বালু ভর্তি ট্রাক। এরা প্রভাবশালী। কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করে না। একই চিত্র মানিকছড়ির বড়বিল, যোগ্যাছলা, পাক্কাটিলার ও তুলাবিল এলাকার। এ সব এলাকার প্রতি কদমে কদমে দেখা মিলবে বালু উত্তোলনের চিত্র।
বালু উত্তোলনের বিষয়ে গুইমারা উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি বলেন, কোথায় কখন বালু উত্তোলন করা হচ্ছে এমন সঠিক তথ্য পেলে ঘটনাস্থলে গিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয় মানিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সাথে যোগাযোগ করার জন্য মুঠোফোনে একাধিকবার কল করলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।
খাগড়াছড়ি জেলা প্রশাসক মো. সহিদুজ্জামান বলেন, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের ধরতে প্রতিনিয়ত অভিযান চালানো হচ্ছে। এছাড়াও কোথায় কোথায় বালু উত্তোলন করা হচ্ছে তার সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহযোগিতা নিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
You cannot copy content of this page
Leave a Reply