আজ ২০শে কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৫ই নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

ভোটারদের কেন্দ্রে আনাই বড় চ্যালেঞ্জ!

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে ভোটারদের কেন্দ্রে নিয়ে আসাই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, বেহাল সড়ক, জলাবদ্ধতা, ঝুঁকিপূর্ণ ভোট কেন্দ্র, ভোট কেন্দ্রে পানি জমে যাওয়া ও যানজটে ভোটাররা কেন্দ্রে যাবেন কি না- এ নিয়ে সংশয় দেখা দিয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে মেয়র প্রার্থী, নির্বাচনী কর্মকর্তা, ম্যাজিস্ট্রেট ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে মতবিনিময় সভায় এসব সীমাবদ্ধতার কথা তুলে ধরা হয়। এসব তুলে ধরেন বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্র্তারা। অবিলম্বে এসব সমস্যা সমাধানের দাবিও জানান তারা। এছাড়া প্রাকৃতিক দুর্যোগ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন প্রার্থী ও ভোটাররা। এদিকে একটি গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা বলছেন, মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নির্বাচনে কালো টাকার লেনদেন হতে পারে। সাইবার ক্যাফে থেকে গুজব ছড়িয়ে অস্বাভাবিক নির্বাচনী পরিস্থিতি সৃষ্টি করা হতে পারে। অন্য একটি সংস্থার সদস্যদের দাবি, মসজিদ-মাদ্রাসার মাইক ব্যবহার করেও গুজব ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে।

গাজীপুরের জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান হুমায়ুন কবীরের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার প্রধান অতিথি নির্বাচন কমিশনার (ইসি) মাহবুব তালুকদার দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, গাজীপুরের নির্বাচনের সঙ্গে তাদের অস্তিত্ব জড়িয়ে আছে। যে কোনো মূল্যে গাজীপুরবাসীকে একটি অবাধ, নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন উপহার দেবেন। নির্বাচনে মানি পাওয়ার ও মাসল পাওয়ার প্রতিহত করার ঘোষণাও দেন তিনি।

মতবিনিময় সভায় সব মেয়র প্রার্থীকে একই সঙ্গে প্রচারণা চালানোর প্রস্তাব দেন আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম ও বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্টের মেয়র প্রার্থী জালাল উদ্দিন। জাহাঙ্গীর আলম বলেন, রাস্তাঘাটের যে অবস্থা, তাতে ভোটারদের ভোট কেন্দ্রে আসতে সমস্যা হবে। তাদের কষ্ট হবে। যারা নির্বাচনের দায়িত্বে আছেন এবং সিটি কর্পোরেশনের যারা দায়িত্বে আছেন, তারা যেন এ রাস্তাগুলো মেরামতের ব্যবস্থা করেন। জালাল উদ্দিন বলেন, প্রতিকূল আবহাওয়ায় পোস্টারিং করা যাচ্ছে না। সড়কে পানি জমে জলাবদ্ধতা তৈরি হচ্ছে। ভোট কেন্দ্রে পানি জমে গেলে ভোটার উপস্থিতি কম হতে পারে। এ সময় বিএনপি প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের প্রতিনিধি মাহবুবুর রহমান বলেন, তাদের প্রচারণার দায়িত্বে থাকা একজনকে পুলিশ এলাকায় প্রবেশ করতে দিচ্ছে না। তাদের নানাভাবে হয়রানিও করা হচ্ছে। জেলা প্রশাসক ড. দেওয়ান হুমায়ুন কবীর বলেন, আপনারা চাইলে একমঞ্চে-একসঙ্গে প্রচারণা চালাতে পারেন। এতে কোনো বাধা নেই। বিএনপির প্রার্থীর প্রতিনিধির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, যতদূর জানি পুলিশ কাউকে অহেতুক হয়রানি করছে না। সভায় গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কেএম রাহাতুল ইসলাম কেন্দ্র প্রস্তুতির বিষয়ে অগ্রগতি এবং রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে বলে জানান।

পুলিশ কাউকে হয়রানি করছে না বলে দাবি করে জেলা পুলিশ সুপার হারুন অর রশীদ বলেন, নির্বাচন কমিশন যেভাবে নির্দেশনা দিচ্ছে, সেভাবে কাজ করছি। হয়রানির অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, নিরীহ কাউকে হয়রানি বা গ্রেফতার করা হচ্ছে না। যানজট নিরসনে অতিরিক্ত ৩০০ ট্রাফিক পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে বলেও তিনি দাবি করেন। সভায় নির্বাচনের রিটার্নিং অফিসার রকিব উদ্দিন মণ্ডল বলেন, যেসব অভিযোগ আসছে, তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। সভায় ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের মেয়র প্রার্থী নাসির উদ্দিন বলেন, সেনাবাহিনীর প্রতি সাধারণ মানুষের আস্থা আছে। তিনি নির্বাচনে সেনাবাহিনী মোতায়েনের দাবি করেন। গাজীপুরে সুষ্ঠু নির্বাচন হবে কি না- এ বিষয়ে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। এ বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসক বলেন, নির্বাচনে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড হবে এবং ভোটাররা সুষ্ঠুভাবে ভোটদান করবেন। সভায় র‌্যাব, বিজিবি, আনসার, হাইওয়ে পুলিশের প্রতিনিধি ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিনিধিরা বক্তব্য দেন।

এদিকে মতবিনিময় সভার শেষদিকে উপস্থিত হন গাজীপুর জেলা বিএনপির সভাপতি ও বিএনপির মেয়র প্রার্থীর নির্বাচনী প্রচারণা কমিটির প্রধান ফজলুল হক মিলন। বিএনপির মেয়র প্রার্থী হাসান উদ্দিন সরকারের পক্ষে বক্তব্য দিতে চান। এ সময় তাতে আপত্তি করেন সভার সভাপতি জেলা প্রশাসক দেওয়ান হুমায়ুন কবীর। তিনি বলেন, বিএনপির মেয়র প্রার্থীর পক্ষে এরই মধ্যে একজন বক্তব্য দিয়েছেন। ফজলুল হক তবুও তার বক্তব্য চালিয়ে যান। এ সময় আওয়ায়ী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম এর প্রতিবাদ করেন। জেলা বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক শিল্পপতি সোহরাব উদ্দিন যুগান্তরকে বলেন, আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম নিয়মবহির্ভূতভাবে প্রতি ওয়ার্ডে ৩-৪টি নির্বাচনী অফিস তৈরি করে প্রচারণা চালাচ্ছেন। এমনকি ফুটপাতেও তারা নির্বাচনী অফিস করেছেন। অথচ প্রতি থানায় একটি করে অফিস থাকার কথা। ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছেন না। উল্টো বিএনপির নেতাকর্মী যারা প্রচারণা চালাচ্ছেন, ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের ওপর নজরদারি করছেন।

টঙ্গী, বাসন ও সাবেক গাছা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে দেখা গেছে, সড়ক বেহাল। কোথাও কাদা আবার কোথাও পানি জমে আছে। এ নিয়ে ভোটাররা তাদের অসন্তোষের কথা জানান। বেহাল সড়ক, জলাবদ্ধতা এবং যানজটে অনেক ভোটার ভোট দিতে তেমন আগ্রহী নন। এ বিষয়ে টঙ্গীর ৫৬ নম্বর ওয়ার্ডের বাসিন্দা ব্যাংক কর্মকর্তা আবদুল আলীম যুগান্তরকে বলেন, সামান্য বৃষ্টি হলে পুরো টঙ্গীতে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়। ঘর থেকে বের হওয়ার উপায় থাকে না। ফলে নির্বাচনের দিন দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া থাকলে দেখা যাবে ভোট কেন্দ্র তলিয়ে গেছে। তখন ভোট দেয়ার আগ্রহ থাকবে না। সাবেক গাছা ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় একই অবস্থা। বৃষ্টি হলে ঘর থেকে বের হওয়ার কোনো উপায় থাকে না।

গাজীপুরের নির্বাচন কমিশনের অস্তিত্বের প্রশ্ন : ইসি মাহবুব তালুকদার বলেন, শুধু দেশবাসী নয়, সারা বিশ্ব এই নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছে। কারণ বিশ্ববাসী মনে করে, এই নির্বাচনের মধ্য দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে আমাদের সক্ষমতা প্রমাণিত হবে। এ কারণে সারা বিশ্ব এই নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছে। তাই এ নির্বাচনের সঙ্গে আমাদের অস্তিত্বের বিষয় জড়িয়ে আছে। নির্বাচন সুষ্ঠু না হলে গাজীপুরবাসী পরাজিত হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন না করে আমরা গাজীপুরবাসীকে পরাজিত দেখতে চাই না। মানি পাওয়ার ও মাসল পাওয়ার প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়ে তিনি বলেন, আমি দুটি বিষয়ে বলতে চাই। একটি হল মানি পাওয়ার। অপরটি হচ্ছে মাসল পাওয়ার। এ দুটি বিদ্যমান থাকলে নির্বাচন সুষ্ঠু হবে না। এ দুটি আমাদের প্রতিহত করতে হবে। ব্যালট বাক্স ছিনতাই রোধে পুলিশকে কঠোর হওয়ার নির্দেশ দিয়ে তিনি বলেন, পুলিশ কর্মকর্তাদের বলতে চাই, ভোটের আগের দিন ব্যালট পেপার ছিনতাইয়ের চেষ্টা, ব্যালট বাক্স ছিনিয়ে ভরার চেষ্টা আপনারা কঠোরভাবে দমন করবেন। নির্বাচনের এই কালচার আর চলতে দেয়া হবে না।

ইসি মাহবুব বলেন, সংবিধানের প্রধান স্তম্ভ হল গণতন্ত্র। গণতন্ত্রকে সংহত করতে প্রধান কাজ হল নির্বাচনকে অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করা। যারা জবরদখল করে নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে চায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা সর্বশক্তি নিয়োগ করে তা প্রতিহত করবে। নির্বাচন সংশ্লিষ্ট সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছি, নির্ভয়ে দৃঢ়তার সঙ্গে নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে হবে। আইনশৃঙ্খলার ব্যাপারে আমরা জিরো টলারেন্সে রয়েছি। প্রার্থীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, প্রার্থীদের বলতে চাই- আপনারা আচরণবিধি লঙ্ঘন করবেন না। আচরণবিধি লঙ্ঘিত হলে আপনাদের প্রার্থিতা বাতিল হতে পারে। আমাদের সেই অবস্থায় ফেলবেন না। মতবিনিময় সভা শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ইসি মাহবুব তালুকদার বলেন, সামগ্রিক নির্বাচনকেই আমরা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিচ্ছি। কারণ এই নির্বাচন আমাদের অস্তিত্বের অংশ। এই নির্বাচন করে আমাদের অস্তিত্বের বিষয়টি প্রমাণ করতে হবে। একটি অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন জাতিকে উপহার দেব।

প্রথমবার পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেয়া হবে : সভায় জেলা প্রশাসক দেওয়ান হুমায়ুন কবীর জানান, এবারই প্রথমবার প্রার্থীদের পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে। প্রত্যেক মেয়র প্রার্থীর চারজন করে পোলিং এজেন্ট এবং প্রত্যেক কাউন্সিলর প্রার্থীর একজন করে পোলিং এজেন্টকে ৫ মে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। পরে তারা অন্য পোলিং এজেন্টদের প্রশিক্ষণ দেবেন। এ সময় তিনি আরও জানান, আগামী ৯ মে প্রার্থীদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার খন্দকার রকিব উদ্দিন। নির্বাচনের দিন গাজীপুরের সব শিল্পকারখানা বন্ধ রাখা হবে বলে জানানো হয়েছে। নির্বাচনের আগে গাজীপুরে বসবাসকারী বৈধ অস্ত্রধারীদের কাছ থেকে অস্ত্র জমা নেয়া হবে। ভোটার না কিন্তু কারখানায় কাজ করেন, তারা নির্বাচনের সময় গাজীপুরে থাকতে পারবেন। তবে তাদের অবশ্যই আইডি কার্ড থাকতে হবে।

গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন: আহমদুল হাসান আসিক ও শাহ সামছুল হক রিপন, যুগান্তর

Share

এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

     এ ক্যাটাগরীর আরো সংবাদ

You cannot copy content of this page